বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় পুঁজি পেতে তারা এখনো নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ে নারীদের সঞ্চয় ও লেনদেন বাড়লেও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে জামানত, ডিজিটাল জ্ঞানের অভাব এবং সামাজিক মানসিকতার মতো বিষয়গুলো বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট আমানতের প্রায় অর্ধেকই এসেছে নারী গ্রাহকদের কাছ থেকে। পাশাপাশি, নারীদের নামে খোলা ব্যাংক ডিপোজিট ও ঋণ অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বছরে প্রায় ১৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই ইতিবাচক চিত্রের বিপরীতে ব্যাংকিং খাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি হতাশাজনক। ব্যাংকগুলোর মোট কর্মীসংখ্যার মধ্যে নারীর হার মাত্র ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ হওয়ায় নারী উদ্যোক্তাদের চাহিদা ও সম্ভাবনা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
অনেক নারী উদ্যোক্তা অভিযোগ করেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকা সত্ত্বেও ঋণ আবেদন করলে তাদের ব্যবসার সম্ভাবনাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে জামানতের শর্ত পূরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ ছাড়া, ডিজিটাল ব্যাংকিং ও বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারে অনভ্যস্ততা এবং প্রশিক্ষণের অভাবে অনেকেই আধুনিক আর্থিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অথচ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৪৩ শতাংশে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশই নারী। তাদের শ্রমের ওপর ভর করেই এ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। কৃষি খাতেও বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তারা ‘কৃষক’ হিসেবে স্বীকৃতি পান না বললেই চলে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, নারীদের গৃহস্থালি কাজের অর্থনৈতিক মূল্য হিসাব করা হলে তা অনেক দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশে নারীদের এ অদৃশ্য শ্রমের কোনো আর্থিক মূল্যায়ন হয় না, যা জাতীয় পরিসংখ্যানে তাদের প্রকৃত অবদানকে আড়াল করে রাখে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কেবল ব্যক্তিগত ক্ষমতায়নের বিষয় নয়, এটি একটি কার্যকর অর্থনৈতিক কৌশল। একজন নারী যখন স্বাবলম্বী হন, তখন তার আয় পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে। তাই নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পুঁজির জোগান সহজ করা এবং তাদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়া হলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

