কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা জোরদার এবং সহিংসতা ও হয়রানি নির্মূলের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কনভেনশন অনুসমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মনে করছে, এই পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। তবে সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো, আর এ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন কারখানা মালিকদের প্রতিনিধিরা।
যে তিনটি কনভেনশন অনুসমর্থন করা হচ্ছে সেগুলো হলো—পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক কনভেনশন ১৫৫, এর প্রচারণামূলক কাঠামোবিষয়ক কনভেনশন ১৮৭ এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধবিষয়ক কনভেনশন ১৯০। এর মধ্যে ১৫৫ ও ১৮৭ নম্বর কনভেনশন দুটি ২০২২ সাল থেকে আইএলওর মৌলিক কনভেনশনের মর্যাদা পেয়েছে।
গত ২৪ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। চলতি মাসেই কনভেনশনগুলো স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এতে সই করবেন। এরপর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আইএলওর মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ হাউংবোর কাছে তিনি অনুসমর্থনের প্রমাণপত্র হস্তান্তর করবেন বলে জানা গেছে।
শ্রমসচিব মো. সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, অনুসমর্থনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে।
সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, অধিকারভিত্তিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছিল। এর ফলে শ্রমিকের নিরাপত্তা অধিকারের পরিধি স্পষ্ট হবে এবং অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়া সহজ হবে। তবে তিনি এগুলো বাস্তবায়নে আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
অন্যদিকে, এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, “অস্থির সময়ে সরকার কেন স্বপ্রণোদিত হয়ে আইএলওর তিন কনভেনশন অনুসমর্থন করতে যাচ্ছে, আমরা তা বুঝতে পারছি না।” যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো দেশ কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন করেনি উল্লেখ করে তিনি জাতীয় স্বার্থে সরকারের এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানান।
তবে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতে রানা প্লাজা বা তাজরীন ফ্যাশনসের মতো ট্র্যাজেডি ঘটেনি, তাই তাদের পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই অনুসমর্থনের ফলে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষের দায়বদ্ধতা বাড়বে, যা letztendlich মালিকদের জন্যও মঙ্গলজনক হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালে গৃহীত কনভেনশন ১৫৫ এখন পর্যন্ত ৮৩টি দেশ এবং ২০০৬ সালে গৃহীত কনভেনশন ১৮৭ মোট ৬৯টি দেশ অনুসমর্থন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ এখন পর্যন্ত এই দুটি কনভেনশন অনুসমর্থন করেনি। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে গৃহীত কনভেনশন ১৯০ এ পর্যন্ত ৪৯টি দেশ অনুসমর্থন করেছে, যা বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের ২০০৯ সালের একটি নির্দেশনার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আইএলও ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাংলাদেশ এ পর্যন্ত সংস্থাটির ৩৬টি কনভেনশন ও একটি প্রটোকলে অনুস্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে ৩১টি বর্তমানে কার্যকর। সম্প্রতি বাংলাদেশ ২০২৪-২৭ মেয়াদের জন্য আইএলওর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে।

