ভুল আর প্রতারণামুলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে আশ্রয় নেয়ায় অভিযোগ বহুদিনের। আর সেদিকে নজর রেখে কানাডা সরকার তার চিরাচরিত অভিবাসননীতি কঠোর করে ফেলছে। পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক মানুষকে জায়গা করে দেয়া বিশ্বের অন্যতম অভিবাসীবান্ধব দেশ হিসেবে পরিচিত কানাডা এখন এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা যাকে ‘টাইটেনিং ইরা’ বা কড়াকড়ির যুগ বলে অভিহিত করছেন।
সকল তথ্য মাথায় রেখেই সম্প্রতি কানাডার শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম সিবিসি নিউজ সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালে দেশটির ফেডারেল সরকার স্পষ্টভাবে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া কঠোর করছে। লক্ষ্য এখন রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসী গ্রহণ নয়, বরং গভীর যাচাই–বাছাই শেষে এক নিয়ন্ত্রিত সংখ্যা।
জানা গেছে, নতুন এই নীতির প্রভাব পড়েছে সব ক্ষেত্রেই—স্টাডি পারমিট, ওয়ার্ক পারমিট, ভিজিটর ভিসা, এমনকি স্থায়ী বসবাসের (PR) প্রোগ্রাম যেমন এক্সপ্রেস এন্ট্রি ও প্রভিনশিয়াল নমিনি প্রোগ্রামেও।
IRCC (ইমিগ্রেশন, রিফিউজি অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা)–এর তথ্যমতে, চলতি বছর রিফিউজাল রেট বা আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার বহু বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ওই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০২৫–২০২৭ ইমিগ্রেশন লেভেলস প্ল্যান অনুসারে অস্থায়ী বাসিন্দাদের (temporary residents) সংখ্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনাই সরকারের লক্ষ্য।
২০২৫ সালে এই হার দেশের মোট জনসংখ্যার ৭.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ২০২৭ সালের মধ্যে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে আবেদনকারীদের প্রতি বার্তা একটাই—“অলসতা বা ভুলের জায়গা নেই।” অফিসাররা এখন আর অনুমোদনের কারণ খোঁজেন না; বরং অসামঞ্জস্য বা সন্দেহের কারণ পেলেই বাতিল করেন। প্রতিবেদনটিতে গভীর অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বেশকিছু কারণ খুজে বের করা হয়েছে।
প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রমাণে ব্যর্থতা
নতুন ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি রিজেকশন হচ্ছে “Genuine Intent” না দেখাতে পারায়। যেমন, পড়াশোনার আবেদনকারী যদি এমন কোনো কোর্স বেছে নেন যা তার শিক্ষা বা কর্ম–অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কহীন, তবে সেটি অফিসারের কাছে সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। একইভাবে, ভিজিটর ভিসায় নিজ দেশে যথেষ্ট পারিবারিক বা আর্থিক বন্ধন না থাকলে ফিরবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়।
জানা যায়, IRCC এখন উন্নত রিস্ক–অ্যাসেসমেন্ট মডেল ব্যবহার করছে, যেখানে আবেদনকারীর ভ্রমণ ইতিহাস, আর্থিক আচরণ, এমনকি পূর্ববর্তী রিজেকশন রেকর্ডও ক্রস–চেক করা হয়।
ক্ষুদ্র ভুলে বড় ক্ষতি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নথিপত্রে ক্ষুদ্র ভুল বা ঘাটতিও এখন রিজেকশনের কারণ হচ্ছে। রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া রেফারেন্স লেটার, অসম্পূর্ণ ব্যাংক–স্টেটমেন্ট বা মেয়াদোত্তীর্ণ মেডিকেল রিপোর্ট—সবকিছুই ঝুঁকিপূর্ণ। IRCC নথি যাচাইয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করছে, যা ফন্ট, মেটাডেটা ও ডকুমেন্ট–ফরম্যাট মিলিয়ে জালিয়াতি শনাক্ত করতে পারে।
স্থায়ী বসবাসেও কঠোরতা
এক্সপ্রেস এন্ট্রি ও PNP–তে আবেদনকারীরা এখন নিয়মিত পাচ্ছেন Procedural Fairness Letter (PFL)—যেখানে আবেদনপত্রে অসামঞ্জস্য ধরা পড়লে চূড়ান্ত রিজেকশনের আগে একবার ব্যাখ্যার সুযোগ দেওয়া হয়। অসংখ্য আবেদনকারী ভুল NOC কোড, চাকরির দায়িত্বের অমিল, কিংবা প্রুফ অব ফান্ডস ঘাটতি বাতিলের কারণ হচ্ছেন।বিশেষজ্ঞরা দেখছেন এখন অফিসাররা ট্যাক্স রেকর্ড, নিয়োগকর্তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, এমনকি আবেদনকারীর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলও যাচাই করছেন।
নতুন নিয়ম মানতে ব্যর্থতায় বাড়ছে নিষেধাজ্ঞা
২০২৫ সালে ভুয়া আবেদন (“ডামি অ্যাপ্লিকেশন”) জমা দিয়ে কানাডায় সময় বাড়ানোর প্রচেষ্টা বাড়লেও এখন তা সরাসরি ‘অপব্যবহার’ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। IRCC ও CBSA যৌথভাবে তৈরি ডেটা–টুলের মাধ্যমে এসব ধাঁচ শনাক্ত করছে। একবার ধরা পড়লে বহু বছরের জন্য প্রবেশ–নিষেধাজ্ঞা জারি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
পারিবারিক স্পনসরশিপেও বাড়তি নজরদারি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এছাড়া স্পনসরশিপ প্রক্রিয়াতেও কড়াকড়ি বেড়েছে। এখন CRA–এর সর্বশেষ আয়–প্রমাণপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক, এবং সম্পর্ক–প্রমাণ হালনাগাদ না হলে আবেদন ফেরত চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে, অসম্পূর্ণ বা আনসাইনড ফর্মের কারণে অনেক আবেদন অটোমেটিকভাবে রিজেক্ট হচ্ছে নতুন ডিজিটাল ইনটেক সিস্টেমে।
অভিবাসন নিয়ে দীর্ঘসময় কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এখন সফল আবেদন মানে শুধু যোগ্যতা নয়, বরং নিখুঁত প্রস্তুতি। প্রতিটি নথি যাচাই, সময়সীমা মেনে চলা এবং লাইসেন্সধারী কনসালট্যান্টের সহায়তা—এই তিনটি বিষয়ই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। IRCC–র এক কর্মকর্তার ভাষায়,“ইমিগ্রেশন এখন অনুমোদনের নয়, প্রমাণের খেলা।”

