অবশেষে স্বাক্ষরিত হলো জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫। আর সেই সনদে স্বাক্ষর শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বললেন, এর মাধ্যমে ‘নতুন বাংলাদেশের সূচনা’ হলো। শুক্রবার ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জাতীয় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের নায়কদের স্মরণ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তরুণদের অবদানের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের তরুণেরা ছাড়া পৃথিবীতে এত তরুণ দিতে পারে, এত তাজা শক্তি দিতে পারে, এত সৃজনশীল মানুষ দিতে পারে, এত বিশ্বস্ত মানুষ দিতে পারে—খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই সে দেশকে গঠন করার দায়িত্ব আগামী সরকারকে নিতে হবে। পরবর্তী সরকারগুলোকে নিতে হবে। সেটার জন্যই প্রস্তুতি হচ্ছে এই আমাদের সনদ।’ উল্লেখ্য, যেসব ছাত্র নেতৃত্বের মাধ্যমে আজকের এই আয়োজন সম্ভব হলো তাদের অনেকেই এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের কথা বলেছি। যে সুর আজকে আমরা এখানে বাজালাম, সেই সুর নিয়ে আমরা নির্বাচনের দিকে যাব। ঐক্যের সুর, ঐক্যের মধ্য দিয়ে আমরা নির্বাচনের দিকে যাব। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে এবং এই ঐক্য যেন বজায় থাকে। আজকে ঐকমত্যে আমরা যে রকম সনদ করলাম। রাজনীতির ব্যাপারেও, নির্বাচনের ব্যাপারেও আপনারা রাজনৈতিক নেতারা বসে, বিভিন্ন দলের নেতারা বসে একটা সনদ করেন, কীভাবে নির্বাচন করবেন। সবাই মিলে এমনভাবে নির্বাচন করব, দুনিয়ার কেউ এসে বলতে পারবে না এখানে ক্ষতি হয়েছে। বাইরের লোক এসে কেন আমাদের বলবে, তোমরা এটা ঠিক করো নাই, ওটা ঠিক করো নাই। আমরা কী জাতি হলাম যে বাইরের কথার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে?’ এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, ‘আমার অনুরোধ, আপনারা আবার ঐকমত্য কমিশন বলেন, কমিটি বলেন, নিজেরা বসুন—নির্বাচনটা কীভাবে সুন্দরভাবে করবেন, ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখবেন। বিশ্বের জন্য উদাহরণ হবে, আমরা সে রকম নির্বাচনটা করতে চাই। আমরা ইনশা আল্লাহ পারব। আজকে সেই পারার একটা চিহ্ন আমরা এখানে রেখে গেলাম।’ ঐকমত্যের মাধ্যমে যে ‘কঠিন কঠিন কাজ’ সমাধান করা যায় মন্তব্য করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম। যেখানে আইনকানুন ছিল না। মানুষের ইচ্ছায় যা ইচ্ছা তা করতে পারত। এখন আমরা সভ্যতায় আসলাম। এখন তো কাগজে আমরা প্রমাণ করলাম, সেই সভ্যতা আমরা নিয়ে আসলাম এবং কাজে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা সেই সভ্যতা অর্জন করেছি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা কীভাবে ঐকমত্যে এসেছি, কী কী বিষয়ে বিবেচনা করেছি, কীভাবে এসেছে, তার জন্য যে তাঁরা বিতর্কগুলো করেছেন দিনের পর দিন এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য, সেগুলোর ভিডিও ইস্যুভিত্তিক তৈরি করে করে ছাত্রদের হাতে দিয়ে দেওয়া হবে, তারা যেন অনুপ্রাণিত হয়।’ প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে উঠে আসে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের মালিকানা ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের বিষয়টিও। তিনি বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর আমাদেরই অঞ্চল। আমাদেরই বাংলাদেশের অংশ। এই অংশ অত্যন্ত সম্পদশালী অংশ। আমরা পূর্ণ ব্যবহার করতে চাই সম্পদকে। আমরা এগিয়ে যেতে চাই। আমরা তর্কবিতর্কের মধ্যে যেতে চাই না। সে জন্যই আজকে সনদ হলো। এই সনদ তর্কবিতর্কের অবসান করবে।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমাদের জন্য আজকে নবজন্ম। আমাদের নবজন্ম হলো আজকে। এই স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করলাম। সেটা যেন সঠিকভাবে আমরা যেতে পারি। আমরা একমত হয়েছি সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’
এই অগ্রযাত্রায় পথ দেখানোর ভার তরুণদের দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যেই তরুণেরা এই দিনটিকে সম্ভব করেছে, এ বাংলাদেশের আনাচকানাচে এই পরিবর্তনের জন্য যারা জীবন দিয়েছে তারা—এই তরুণেরাই আবার বাংলাদেশকে নতুন করে গড়বে। এই চিন্তাধারার আলোকে তারা এই দেশকে গড়বে। তারা এই দেশের নেতৃত্ব দেবে। তারা আমাদের পথ দেখাবে।’
ভাষণের আগে জুলাই জাতীয় সনদে সই করেন মুহাম্মদ ইউনূস। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ কমিশনের সদস্যরাও সই করেন সনদে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যাত্রার শুরুটা ‘ভয়ে ভয়ে’ হয়েছিল মন্তব্য করে এই কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সমস্ত জাতি একসঙ্গে হয়ে, সমস্ত রাজনৈতিক নেতা একসঙ্গে হয়ে তাঁরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করছেন। এ রকম ঘটনা ঘটবে, এ রকম কেউ আমরা চিন্তাও করতে পারিনি। যখন ঐকমত্য কমিশন গঠন করলাম, মনে মনে আশা ছিল যে হয়তো দুই–একটা বিষয়ে তাদের এক করতে পারব।’ নানা বিষয়ে মতানৈক্য পেরিয়ে জুলাই সনদে দলগুলোকে এক করতে পারার কৃতিত্ব জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের দেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবেন। তাঁদের নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে। লোকে চিন্তা করবে যে তাঁরা কীভাবে এটা করেছিলেন!
জুলাই সনদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, ‘এখানে স্বাক্ষর করলাম সবাই মিলে, সেটা দিয়ে বাংলাদেশ পরিবর্তন হবে। এই পরিবর্তন সম্ভব হলো ওই গণ-অভ্যুত্থানের কারণে। এটা হলো দ্বিতীয় অংশ। সেটা তারা করেছিল বলেই আজকে আমরা এই সুযোগ পেলাম। আমরা পুরোনো কথাবার্তা সব ফেলে নতুন কথাগুলো আমাদের জীবনে নিয়ে আসলাম। আমাদের জাতীয় জীবনে নিয়ে আসলাম। আমাদের সংবিধানের পরিবর্তনের মধ্যে নিয়ে আসলাম। আমাদের অন্যান্য বিষয়ে সরকার চালানোর বিষয়ে নিয়ে আসলাম। অনেক বিষয় এসেছে পরিবর্তনের ভেতরে। এই পরিবর্তন এখন আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা সেই পথে অগ্রসর হব।’
জুলাই জাতীয় সনদ সই করার অনুষ্ঠান থেকে গোটা জাতি অনুপ্রাণিত হবে মন্তব্য করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘অন্য দেশ আমাদের কাছ থেকে শিখবে, সে সামর্থ্য আমাদের আছে। আজকে যেই সনদ সই করল, এটা বহু দেশ শিখতে আসবে, এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে আপনাদের বলে রাখলাম। এই যে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, এ রকম আরও বহু উদাহরণ আমরা সৃষ্টি করতে পারি। সেই পথে আমরা যেন যাই।’
আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়েও আজকের ঘোষণায় তার সরকারের সিদ্ধান্ত কয়েকদফা পুনর্ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস।

