দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। রক্তাত্ত হয়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক যুগের ডুরান্ড লাইনের দুইপাশ। পাক-ভারত উত্তেজনা এখন পৌছেছে পাক-আফগান সীমান্তে। পাকিস্তান ও আফগান তালেবান এক সময় যৌথ নিরাপত্তা স্বার্থের কারণে মিত্র ছিল। এখন ইসলামাবাদের অভিযোগের কারণে দুই পক্ষ শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। আর এর অভিঘাতে সংঘর্ষে দুইপক্ষের আড়াইশর বেশি মানুষ হতাহতের খবর আসছে। খবর আল-জাজিরা ও পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সংবাদ সংস্থার।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। শনিবার রাতের এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষে অন্তত আড়াইশ সেনা ও অস্ত্রধারী নিহত হয়েছে।
আফগানিস্তান ৫৮ পাকিস্তানি সেনাকে হত্যার দাবি করলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের ২৩ সেনা নিহত হয়েছে। ইসলামাবাদের দাবি, সংঘর্ষে তালেবান সেনা, অন্যান্য অস্ত্রধারীসহ ২০০ জন নিহত হয়েছে। তীব্র সংঘর্ষের পর দুদেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আলজাজিরা জানায়, পাকিস্তানের পাখতুনখোয়া প্রদেশের সীমান্তে সংঘর্ষগুলো হয়েছে। পাকিস্তান ও আফগান বাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ শুরু হলে তারা একে অপরের সীমান্ত লাগোয়া চেকপোস্টে হামলা চালায়। উভয় পক্ষ সীমান্ত পোস্ট দখল ও ধ্বংস করার দাবি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম ভয়াবহ সীমান্ত সংঘর্ষ।
তালেবান প্রশাসনের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিকা প্রদেশে বিস্ফোরণ ঘটার পর সীমান্তে সংঘাত শুরুর খবর আসে।
আফগানিস্তানে ঘটা ওই বিস্ফোরণের পর কাবুল হামলার জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আর পাকিস্তানের অভিযোগ, তালেবান প্রশাসন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি যোদ্ধাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। তবে কাবুল এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, আমাদের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা শান্তিপ্রিয় আফগান বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে নয়। আশা করি, তালেবান অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা নেবে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তাঁর দেশের দুই প্রতিবেশীকে সংযম প্রদর্শন করতে অনুরোধ করেছেন। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, উত্তেজনা বাড়ানোর পদক্ষেপ এড়িয়ে দুপক্ষকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে সৌদি আরব। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উভয় পক্ষকেই সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পতির আহ্বান জানিয়েছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহবাজ শরিফ শনিবার রাতে আফগান হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, সেনাবাহিনী তাদের কয়েকটি পোস্ট ধ্বংস করেছে। এতেই তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এনায়াতুল্লাহ খোয়ারাজমি বলেন, দুপক্ষের সংঘাত মধ্যরাতেই শেষ হয়ে যায়।
উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে সীমান্ত পরিস্থিতি
শনিবার রাত প্রায় ১০টার দিকে তালেবান সেনারা পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে হামলা শুরু করে। এ সময় সীমান্তের একাধিক স্থানে দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়। পাকিস্তানের কর্মকর্তারা আলজাজিরাকে জানিয়েছেন, খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সীমান্ত এলাকা আঙ্গুর আড্ডা, বাজাউর, কুরম, দির এবং চিত্রালে এসব সংঘর্ষ হয়। এ ছাড়া বেলুচিস্তানের বাহরাম চাহ এলাকায়ও হামলার ঘটনা ঘটে।
তালেবান মুখপাত্র মুজাহিদের দাবি, আফগান বাহিনীর হামলায় ৫৮ জন পাকিস্তানি সৈনিক নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে। তালেবান বাহিনী পাকিস্তানের ২৫টি সেনা পোস্ট দখল করে। আফগানিস্তানের সীমান্ত রেখা পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
আফগানিস্তানের তোলো নিউজ জানিয়েছে, দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কুনার প্রদেশের দুই হাজার ৬৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্র মোতায়েন করেছে। এই সীমান্তেই ঔপনিবেশিক যুগের ডুরান্ড লাইন অবস্থিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আফগান প্রশাসনের নিন্দা করে জানিয়েছে, তারা সীমান্ত অঞ্চল অস্থিতিশীল করতে এবং সন্ত্রাসবাদকে উসকে দিতে এসব হামলা করেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে সব হামলা প্রতিহত করেছি। সীমান্তের ওপর আফগানিস্তানের ২১টি শত্রুতাপূর্ণ অবস্থান অল্প সময়ের জন্য দখল করা হয়েছে।
সংঘর্ষের কারণ কী?
বৃহস্পতিবার দুটি বিস্ফোরণে থরথর করে কেঁপে ওঠে কাবুল। সীমান্তবর্তী পাকতিকা প্রদেশের এক বেসামরিক বাজারে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে। পরদিন শুক্রবার তালেবান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পাকিস্তানকে আফগানিস্তানের সার্বভৌম লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করে। ইসলামাবাদ সরাসরি বিস্ফোরণের অভিযোগ অস্বীকার না করলেও তালেবানকে টিটিপির কার্যক্রম সীমিত করার জন্য বলেছে।
একজন পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, কাবুলে বিমান হামলা চালানো হয়েছে এবং তাদের লক্ষ্য ছিল টিটিপি নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ। একটি গাড়িতে থাকা অবস্থায় মেহসুদকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়।
ইসলামাবাদভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দুই দেশের সংঘাতে অন্তত দুই হাজার ৪১৪ জন নিহত হয়েছে। গত বছর সীমান্ত সংঘাতে উভয় পক্ষের দুই হাজার ৫৪৬ জন নিহত হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে সীমান্তে হামলা বেড়েছে। তা ছাড়া পাকিস্তান আফগান শরণার্থীদের বিতাড়িত করার পর থেকে টিটিপি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কয়েক দশকের সংঘাত থেকে পালিয়ে অন্তত ৩০ লাখ আফগান শরণার্থী এখন পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে।

